নিট হিসাব ছাড়াই জুন শেষে অর্ধবছরের পরিচালন মুনাফা দেখাচ্ছে প্রায় সব ব্যাংক। কোনো কোনো ব্যাংকের এই মুনাফা ৫৫০ কোটি টাকা পর্যন্ত দেখানো হচ্ছে। এর মধ্যে এমনও ব্যাংক রয়েছে যার বকেয়া, কর এবং নিরাপত্তা সঞ্চিতি রক্ষা হিসাবে ধরলে প্রদর্শিত এই মুনাফা রীতিমতো লোকসানে পরিণত হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
কয়েকটি ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেছে, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসের লাভ–ক্ষতির হিসাব সোমবার (১ জুলাই) চূড়ান্ত করেছে বেশির ভাগ ব্যাংক। প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, ২০২৪ সালের প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারি–জুন) রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা দেখানো হয়েছে ২ হাজার ২৬০ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময় ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফা ছিল ১ হাজার ৬৮০ কোটি। অর্থাৎ পরিচালন মুনাফা বেড়েছে ৫৮০ কোটি টাকা। অবশ্য ব্যাংকটির অন্যান্য দায় বাদ দিলে নিট মুনাফা কমবে, এমনকি নেতিবাচকও হতে পারে!
একইভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংকের মুনাফা দেখানো হয়েছে ৪৫০ কোটি। ২০২৩ সালের একই সময় ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফা ছিল ৩২০ কোটি। এখানেও প্রকৃত হিসাবে মুনাফা তলানিতে নামতে পারে।
অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফার প্রবৃদ্ধির তথ্য দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। দেশের ব্যাংকগুলোর আয়ের বড় একটি অংশ আসে বৈদেশিক বাণিজ্যের কমিশন থেকে। বিদায়ী বছর আমদানি কমেছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ। শ্লথ ছিল রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধিও। যদিও শেষের দিকে রেমিট্যান্সের গতি কিছুটা বেড়েছে। আবার খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় সব ব্যাংকেরই। কিস্তি পরিশোধ অনিয়মিত হয়ে পড়ায় বাড়ছে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ। তারল্য সংকট, মূলধন ঘাটতি, সঞ্চিতি (প্রভিশন) ঘাটতিসহ বেশির ভাগ ব্যাংকের আর্থিক ভিত নাজুক হয়ে উঠেছে। এরপরও ২০২৪ সালের প্রথম ছয় মাসে ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফা বৃদ্ধি দেখানো হচ্ছে।
এদিকে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে বছরের প্রথম ছয় মাসে সাউথইস্ট ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা দেখানো হয়েছে ৫৭৯ কোটি টাকা। গত বছরের ছিল ৪০৭ কোটি টাকা। সে হিসাবে মুনাফা বেড়েছে ১৭২ কোটি টাকা। এ ছাড়া মধুমতি ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা দেখানো হয়েছে ১৮০ কোটি টাকা, আগের বছর ছিল ৮১ কোটি টাকা। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংকটির মুনাফা বেড়েছে ৯৯ কোটি টাকা। ইউনিয়ন ব্যাংক ২৫০ কোটি ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ২১১ কোটি টাকা মুনাফা দেখিয়েছে।
ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফায় বড় প্রবৃদ্ধির বিষয়ে জানতে চাইলে একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘পরিচালন মুনাফা বাড়ার অর্থ এটি নয় যে ব্যাংক খাত ভালো আছে। সঞ্চিতি সংরক্ষণ ও কর পরিশোধের পর পরিচালন মুনাফার কত অংশ টেকে সেটিই দেখার বিষয়। ব্যাংকগুলোয় মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ প্রতিনিয়ত বাড়ছে। আবার কিছু ব্যাংক মূলধন ঘাটতি ও সঞ্চিতি ঘাটতিতে রয়েছে। ডলার ও তারল্য সংকটের কারণে অনেক ব্যাংক প্রত্যাশা অনুযায়ী ব্যবসা করতে পারছে না।’
বিপুল পরিমাণ ঋণ পুনঃতফসিল সত্ত্বেও চলতি বছরের মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা, যা ইতিহাসের সর্বোচ্চ। এসব ঋণের বিপরীতে সঞ্চিতি রেখে সরকারের কর পরিশোধের পর নিট মুনাফার হিসাব হবে।
পুনঃতফসিল করা ঋণকে ‘স্ট্রেসড’ বা ‘দুর্দশাগ্রস্ত’ হিসেবে দেখায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে পুনঃতফসিলকৃত ঋণের বিপরীতে স্থিতি ছিল ২ লাখ ১২ হাজার ৭৮০ কোটি টাকার বেশি। আবার স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আদায় অযোগ্য হওয়ায় ব্যাংকগুলো ৬৫ হাজার ৩২১ কোটি টাকার ঋণ অবলোপন করেছে। সব মিলিয়ে দেশের ব্যাংক খাতের অন্তত এক–চতুর্থাংশ ঋণই দুর্দশাগ্রস্ত।
উল্লেখ্য, আয় থেকে ব্যয় বাদ দিয়ে যে মুনাফা থাকে সেটিকেই বলা হয় পরিচালন মুনাফা। এটি কোনো ব্যাংক বা প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত মুনাফা নয়। ব্যাংকের ক্ষেত্রে এ মুনাফা থেকে খেলাপি ঋণ ও অন্যান্য সম্পদের বিপরীতে প্রভিশন (নিরাপত্তা সঞ্চিতি) সংরক্ষণ এবং সরকারকে কর পরিশোধ করতে হয়। প্রভিশন ও কর–পরবর্তী এ মুনাফাকেই বলা হয় ব্যাংকের নিট বা প্রকৃত মুনাফা। সুত্র:আজকের পত্রিকা
পাঠকের মতামত